শেখ রাসেল: এক অনন্ত বেদনার কাব্য

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৬০তম জন্মদিন আজ। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ভাই। বোন শেখ রেহানার আদরের রাসু মণি। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়িটি আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন শেখ রাসেল। সময়টা ছিলো লড়াই আর সংগ্রামের-উত্তেজনায় মুখর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে চলেছে স্বাধিকার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। 

রাসেল নামকরণেরও একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। বাবা শেখ মুজিব ছিলেন খুব পড়ুয়া। বঙ্গবন্ধু মাঝেমধ্যে বেগম মুজিবকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের দার্শনিকতা। স্বামীর কাছে এসব শুনে রাসেলের ভক্ত হয়ে ওঠেন বেগম মুজিবও। বার্ট্রান্ড রাসেল শুধু একজন দার্শনিকই ছিলেন না। ছিলেন বিজ্ঞানীও। ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড়ো মাপের বিশ্বনেতা। তিনি বিশ্বকে মানুষের বসবাসের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় করার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন বিশ্ব মানবতার উজ্জ্বল দ্যুতি, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, মুক্তিকামী মানুষের নেতা। সেই চেতনা থেকেই বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে তাদের ছোট সন্তানের নাম রাখা হয় রাসেল।

রাসেলের শিশুকাল কেটেছে বাবার স্নেহ-ভালোবাসা ছাড়াই। বাবা রাজনৈতিক বন্দি হয়ে প্রায়ই কারাগারে থাকতেন। বাবাকে দেখতে না পেয়ে রাসেল মা ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করতেন। এই কষ্ট কেবল ছোট্ট রাসেলই অনুভব করতেন না, বাবা শেখ মুজিবুর রহমানও করতেন। যা স্পষ্টত ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর লেখায়। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ছয় দফা আন্দোলনের পর থেকেই রাজবন্দি হিসেবে জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই বাবাকে রেখে আসবেন না। এই দৃশ্য বঙ্গবন্ধুর খুব খারাপ লাগতো। কারাগারের রোজনামচায় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দেব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি।’ 

বঙ্গবন্ধু রাসেলকে খুব ভালোবাসতেন। সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর বাসায় ফিরে প্রথমেই খুঁজতেন রাসেলকে। রাসেল, রাসেল বলে ভরাট কণ্ঠে ডাকতেন। রাসেলও বাবাকে কাছে পাওয়ার জন্য, বাবার কোলে চড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতো সবসময়। বাবার ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ে ছুটে আসতেন বাবার কাছে। বাবাকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরতেন, কিংবা উঠে পড়তেন কোলে। বঙ্গবন্ধু তাকে কোলে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন পরম মমতায়। বাবার চশমাটাকে দারুণ লাগতো তার, তাই সেটা বাবার চোখ থেকে খুলে নিজের চোখে লাগিয়ে নিতে বেশ মজা লাগতো ওর। গল্প শুনতে খুবই ভালোবাসতো ছোট্ট শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধুও সময় পেলে বেশ আগ্রহ নিয়ে গল্প শোনাতেন।

ভীষণ দুরন্ত ছিলেন রাসেল। তার দুরন্তপনার সঙ্গী ছিলো বাইসাইকেল। সাইকেলে করে স্কুলে যেতেন, পাড়ার আর দশজন সাধারণ ছেলের মতো। সাংবাদিক এ বি এম মূসা তার এক স্মৃতিকথায় শেখ রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কদিন বিকেল পাঁচটার দিকে শাঁ করে ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বরে ঢুকেই আমার সামনে একেবারে পপাতধরণিতল। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ ছেলেটি।…অতঃপর সাইকেলে উঠে লেক পাড়ে উধাও হলো শৈশবের শেষ প্রান্তের ছোট্ট ছেলেটি।…বিকেলে লেকের পূর্বপাড়ে এমনি করে চক্কর মারতো। মধ্যবর্তী ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্বপ্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত সাইকেলারোহীর দৌড়ানোর সীমানা।…এদিকে ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন দুষ্টু ছেলেটির সাইকেল-পরিক্রমা যেনো সীমাবদ্ধ থাকে।’ 

রাসেলের জন্মদিন প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণে বড় বোন শেখ হাসিনা এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, রাসেলের জন্মের আগ মুহূর্তগুলো ছিলো ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড়ো ফুপু ও মেজো ফুপু মার সঙ্গে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেনো আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুপু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো। ফুপু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড়ো ফুপু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়োসড়ো হয়েছিলো রাসেল।’

শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন, ‘আব্বা যখন ৬-দফা দিলেন তারপরই তিনি গ্রেফতার হয়ে গেলেন। রাসেলের মুখে হাসিও মুছে গেলো। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে রাসেল আব্বাকে খুঁজতো। রাসেল যখন কেবল হাঁটতে শিখেছে, আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, আব্বা তখনই বন্দি হয়ে গেলেন। মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আব্বার মামলা-মোকদ্দমা সামলাতে, পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, সংগঠনের  নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। সংগঠনকে সক্রিয় রেখে আন্দোলন-সংগ্রাম চালাতেও সময় দিতে হতো।’ বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইতো না। খুবই কান্নাকাটি করতো। ওকে বোঝানো হয়েছিলো যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো।’

রাসেলের কোমলমতি মনের উদাহরণ আনতে গিয়ে এই বইয়েই আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘মা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। রাসেলকে কোলে নিয়ে নিচে যেতেন এবং নিজের হাতে খাবার দিতেন কবুতরদের। হাঁটতে শেখার পর থেকেই রাসেল কবুতরের পেছনে ছুটতো, নিজ হাতে ওদের খাবার দিতো। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও কবুতর ছিলো। কবুতরের মাংস সবাই খেত। …রাসেলকে কবুতরের মাংস দেয়া হলে খেতো না। ওকে ওই মাংস খাওয়াতে আমরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। ওর মুখের কাছে নিয়ে গেছি, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ওই বয়সে ও কী করে বুঝতে পারতো যে, ওকে পালিত কবুতরের মাংস দেয়া হয়েছে!’

ছোট ভাই রাসেল সম্পর্কে একই গ্রন্থে বোন শেখ হাসিনা আরো লিখেন, ‘রাসেল আব্বাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত। আব্বাকে মোটেই ছাড়তে চাইত না। যেখানে যেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব আব্বা ওকে নিয়ে যেতেন। মা ওর জন্য প্রিন্স স্যুট বানিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, আব্বা প্রিন্স স্যুট যেদিন পরতেন সেদিন রাসেলও পরত। কাপড়-চোপড়ের ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই তার নিজের পছন্দ ছিলো। তবে একবার একটা জিনিস পছন্দ হলে তা আর ছাড়তে চাইত না। ওর নিজের একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিলো। নিজের পছন্দের ওপর খুব আস্তা ছিলো। স্বাধীন মত নিয়ে চলতে চাইত। ছোট মানুষটার চরিত্রের দৃঢ়তা দেখে অবাক হতে হতো। বড় হলে সে যে বিশেষ একটা মানুষ হবে তাতে কোনো সন্দেহ ছিলো না।’

ছোট ভাই রাসেলের প্রতি বোন শেখ রেহানার ছিলো অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালোবাসা। পিঠাপিঠি ভাইবোন হিসেবে খুনসুটিও কম হতো না দু-ভাইবোনের। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুলাই বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মানিতে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে বিমানে উঠার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রাসেল শেখ রেহানাকে জড়িয়ে ধরে রাখেন। জার্মানিতে গিয়ে শেখ রেহানা তার আদরের ভাই রাসেলকে একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে প্রিয় ছোট ভাইয়ের প্রতি হৃদয়ের ভেতর থেকে উচ্চারিত হয়েছে সুললিত ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। 

বঙ্গবন্ধু ছোট কন্যা শেখ রেহানা ভাই রাসেল সম্পর্কে এক স্মৃতিচারণে বলেন, ‘শেখ রাসেল আমাদের ভালোবাসা। আব্বার সঙ্গে আমার ও রাসেলের জাপান, মস্কো ও লন্ডন বেড়াবার সুযোগ হয়। রাষ্ট্রীয় সফর বলেই রাসেল বিদেশিদের সঙ্গে খুব সৌজন্যমূলক ব্যবহার করত। সে ছোট্ট হলেও বুঝতে পারত কোথায়, কীভাবে চলতে শিখতে হবে। ঢাকায় ফিরে আমি যখন মা ও সবার কাছে ওর এই সুন্দর ব্যবহারের গল্প করেছি তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। লন্ডনে বিখ্যাত মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে আমরা যখন বেড়াতে যাই রাসেলের বিস্ময় আর কাটে না। আমরা দুইজন আব্বার সঙ্গে নাটোরের উত্তরা গণভবনেও গিয়েছি। রাসেল সেখানে মাছ ধরত, আমরা বাগানে ঘুরে বেড়াতাম। ঢাকার গণভবনেও রাসেল মাছদের খাবার খাওয়াতো।’

আসলে শেখ রাসেলের মাঝে বঙ্গবন্ধুর সব গুণেরই পূর্বাভাস ছিলো। রাসেলের জ্বলজ্বলে সুতীক্ষ্ণ চোখ দুটোই বলে দেয় ওই শিশুর মাঝে ছিলো ভিন্ন কিছু, আজ বেঁচে থাকলে যে ভিন্নতা বাঙালি জাতি সম্যক অনুধাবন করতে পারত। শিশু বয়সেই লক্ষ করা গেছে বঙ্গবন্ধুর মতোই ছিলো তার উদার হৃদয়, ছিলো মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা। অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলো রাসেল। শিশু বয়সেই অসাধারণ ছিলো তার জ্ঞানবাসনা। বঙ্গবন্ধু তাকে নিয়ে সভা-সমিতিতে যেতেন। জাপান ভ্রমণের সময় তাকে সফরসঙ্গী করেছিলেন। 

শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে আজ ৬০ বছরে পা রাখতেন। ঘাতকরা তা হতে দেয়নি। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্টের সেই কালরাত্রিতে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সবাইকেই হত্যা করে। ঘাতকরা সেদিন এই নির্মমতা থেকে দশ বছরের শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। হত্যা করেছে শেখ পরিবারের সবচেয়ে আদরের ফুটফুটে হাসিমাখা শিশুটিকেও। একটি সুন্দর গোলাপ যেন বিকশিত হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। যা এক অনন্ত বেদনার কাব্য। কী অপরাধ ছিলো নিষ্পাপ শিশুটির? জীবন যার বিকশিত হওয়ার আগেই চলে যেতে হয়।
শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে আজ হতেন পরিপূর্ণ মানুষ। তিনি হতে পারতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের মতোই স্বমহিমায় উজ্জ্বল, বিশ্বমানবতার প্রতীক। হতে পারতেন বোনের পাশে থেকে পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলার কারিগর, আজকের উন্নয়নের বাংলদেশের গর্বিত উদ্যোক্তা-নাগরিক। কিন্তু নিষ্ঠুর ঘাতকরা রাসেলের জীবনকেই কেড়ে নেয়নি, ধ্বংস করেছে তার অবিকশিত সম্ভাবনাও। তার প্রতি জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)