ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর জাল, ভুয়া সনদে স্কুলের প্রধান শিক্ষক!

• জালিয়াতি,ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর জাল ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের পরও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এখনো বহাল!

শিক্ষা নয় শিক্ষকদের যদি জাতির মেরুদণ্ড বলা হলেও ভুল হবে না। কারণ জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ার কাজটি সম্পন্ন করেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কিন্তু যখন শিক্ষকই জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নেন, তখন শিক্ষার্থীরা শিখবে কী?
এমনই এক জালিয়াত ও জাল সনদধারী শিক্ষক নিয়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে চট্টগ্রামের শিক্ষাঙ্গনে। আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম–এর বিরুদ্ধে একের পর এক জালিয়াতি, স্বাক্ষর জাল ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তিনি এখনো বহাল তবিয়তে পদে আসীন। বিভাগীয় কমিশনার ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের তদন্তে অভিযোগগুলো সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তবু প্রশাসনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় হতবাক শিক্ষক সমাজ, অভিভাবক ও স্থানীয় সচেতন মহল।

স্বাক্ষর জাল করে সরকারি কাগজ পাঠানো:

গত ৩১ আগস্ট ২০২৪ বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের ততকালীন পরিচালক ও সভাপতি ম্যানেজিং কমিটি জনাব শাহীনা আক্তার এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণীর ১ম ও শেষ পৃষ্ঠা ঠিক রেখে ভুয়া কার্যবিবরণী সৃজন করেন জাহাঙ্গীর আলম। গত ২৩/০২/২০২৫ খ্রি: এডহক কমিটির কোন সভা অনুষ্ঠিত না হলে ও ‘ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর জাল’ করে নতুন করে একটি ভুয়া কার্যবিবরণী তৈরি করেন। সেই জাল নথি ব্যবহার করে জাহাঙ্গীর আলম তার লিজের এবং অপর ১৫ জন শিক্ষকের এমপিও সংশোধনের জন্য ১৫ মার্চ ২০২৫খ্রি: মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ইএমআইএস সেলে পাঠানো হয়। বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হয়। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক ৪ জুন ২০২৫ তারিখে লিখিত স্বীকারোক্তি দেন। এরপর ১৯ অক্টোবর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে এডহক কমিটির সভাপতিকে “প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ” পাঠানো হয়। কিন্তু নির্দেশ জারি হওয়ার পরও এখনো দৃশ্যমান কোন প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

ভুয়া সনদে একাধিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি:

তদন্তে উঠে এসেছে, জাহাঙ্গীর আলম একদিকে শিক্ষকতা করেছেন বলে দাবি করেছেন লক্ষীপুর জেলার কয়েকটি বিদ্যালয়ে, অন্যদিকে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে অধ্যয়ন করেছেন—যা বাস্তবে একসাথে সম্ভব নয়। তিনি চাকরির সময় ৯ বছরের ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দাখিল করে প্রথম এমপিওভুক্ত হন ২০০২ সালে সীতাকুণ্ডের ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি পাহাড়তলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পান এবং ৯ম গ্রেডে এমপিওভুক্ত হন।

সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ:

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের ২০১২ সালের প্রতিবেদন বলছে, তিনি অবৈধভাবে এমপিওভুক্ত হয়ে সরকারের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তবু তিনি ২০০৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একই বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক পরে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তিনি ইউজিসি কর্তৃক বন্ধ ঘোষিত আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির ভুয়া এম.এ (ইংরেজি) সনদ ব্যবহার করে পদোন্নতি পান—যা শিক্ষা বোর্ডের তদন্তে জাল বলে প্রমাণিত হয়। জালিয়াতির করে দীর্ঘ সময় চাকরি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ এর বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তিনি পাহাড়তলী স্কুল এণ্ড কলেজের অধ্যক্ষ পদ ছেড়ে সুকৌশলে জানুয়ারি ২০১৯ সালে আগ্রাবাদ সরকারী কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদের যোগদান করেন।অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষাবোর্ডে অভিযোগ দায়েরের পর জালিয়াতির বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ২০২৫ সালের ১৯ জুন তিনি সরকারী কোষাগারে দুইটি ট্র্যাকিং নম্বরে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা জমা দেন দায়মুক্তির আশায়।

একই সময়ে দুই চাকরি ও ভুয়া জাতীয়তা সনদ:

২০০৩ সালে তিনি একই সাথে পাহাড়তলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও উত্তর মোহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করেছেন—এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। ওই সময়ে তিনি দুটি প্রতিষ্ঠানের সরকারি বেতন-ভাতা তোলেন। এ ছাড়া তিনি লক্ষীপুর জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের ‘মাতব্বর নিবাস, কমার্স কলেজ রোড’ ঠিকানায় ভুয়া জাতীয়তা সনদ তৈরি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ নেন। ১৯৯১ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী এটি স্পষ্ট ফৌজদারি অপরাধ।

বহাল তবিয়তে ‘মুখোশধারী শিক্ষক’:

শিক্ষা বোর্ড ও বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের তদন্ত ও অভিযুক্তের লিখিত স্বীকারোক্তির পরও প্রধান শিক্ষক পদে বহাল থাকায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। আগ্রাবাদ সি জি এস কলোনি, হাজিপাড়া ও দাইয়া পাড়ার বাসিন্দারা বলেন,“এই ধরনের মুখোশধারী শিক্ষকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থেকে পুরো সমাজকে নষ্ট করছে। প্রশাসন যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এমন জালিয়াতি আরও বেড়ে যাবে।”

প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ:

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক প্রফেসর মো. আবুল কাশেম ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে বিদ্যালয়ের এডহক কমিটিকে চিঠি দিয়ে “বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ” করতে বলেন। বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (উন্নয়ন) মো. রিদুয়ানুল ইসলামও একই নির্দেশনা জারি করেন। কিন্তু শিক্ষা বোর্ড,বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় ও মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে কার্যকর পদক্ষেপ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

আইনজ্ঞদের মত:

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাল সনদ ব্যবহার, স্বাক্ষর জালিয়াতি ও সরকারি অর্থ আত্মসাৎ—এই তিনটি অপরাধেই বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৭১,৪০৬,৪০৯,৪২০,৪৪৮,৪৬৪,৪৬৫, ৪৬৭, ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি জরিমানা ও কারাদণ্ড প্রযোজ্য। অবসরপ্রাপ্ত জেলা জসীম উদ্দিন ভূইয়া বলেন, “যদি সরকারি তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে এটি শুধুমাত্র প্রশাসনিক নয়, সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ। দ্রুত বিচার আইনের আওতায়ও আনা সম্ভব।”

‘ধামাচাপা’র আশঙ্কা:

শিক্ষা প্রশাসনের কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তার নীরবতা এই মামলায় ‘ধামাচাপা’ দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন—“যখন প্রমাণ ও স্বীকারোক্তি দুটোই আছে, তখনও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?”

সচেতন মহলের দাবি:

চট্টগ্রাম নগরীর সচেতন মহল মনে করেন, একজন শিক্ষক যদি বারবার ভুয়া সনদ ও স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে পদোন্নতি পেতে পারেন, তবে তা শিক্ষাপ্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। তারা দ্রুত অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষককে পদচ্যুত করে আইনগত বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন।